মণিপুরী ললিতকলা একাডেমি ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের শিববাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মণিপুরী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যমন্ডিত সাংস্কৃতিক উপাদানকে সংরক্ষণ ও পুনর্জাগরণ করার জন্য মণিপুরীদের একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের জন্য দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ তারিখে মণিপুরী সমাজ কল্যাণ সমিতির তৎকালীন সভাপতি দীননাথ সিংহের নেতৃত্বে একটি মণিপুরী প্রতিনিধিদল মহামান্য রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী (পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি) আব্দুস সাত্তার সাহেবের সাথে ঢাকায় গণভবনে সাক্ষাৎ করেন। সেই সাক্ষাৎকারে নেতৃবৃন্দ মণিপুরীদের জন্য একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের জোর দাবি পেশ করেন। সরকার বিষয়টির ন্যায্যতা উপলব্ধি করেন। সেই সাক্ষাতের প্রায় এক বছরের মাথায় রাষ্ট্রপতির মহিলা বিষয়ক উপদেষ্টা মিসেস ফিরোজা বারী প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং সিলেটের জেলা প্রশাসকের তত্ত¡াবধানে বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মণিপুরী ললিতকলা একাডেমী একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ হিসেবে (তখন পরিচালক পদটি তৈরি করা হয় নি) দায়িত্ব গ্রহণ করেন বালিগাঁও গ্রামের বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী ও ওস্তাদ রামকান্ত সিংহ।
সরকারের কাছ থেকে পাওয়া সামান্য থোক বরাদ্দ নিয়েই আন্তরিক ইচ্ছা ও শিল্পী-শিক্ষকদের ত্যাগের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তার কার্যক্রম চালিয়ে যায়, যার মধ্য দিয়ে মণিপুরী সংস্কৃতির নানান শাখায় অনেক গুণী শিল্পী আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২য় সাফ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মণিপুরী ললিতকলা একাডেমীর তত্ত্ববধানে শিল্পী-বাদকদল অংশগ্রহণ করে দেশবিদেশের বিশিষ্টজনদের নজর কাড়েন। সেই সফরে শিল্পীপ্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতি হসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাথে সাক্ষাৎ করে প্রতিষ্ঠানটিতে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম চালুর আবেদন জানান, তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ মণিপুরী ললিতকলা একাডেমী পরিদর্শন করেন এবং সুপারিশক্রমে তিন লক্ষ টাকা আর্থিক মঞ্জুরি প্রদান করেন। প্রথমত পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা পরিষদে জেলা প্রশাসক (মৌলভীবাজার) সভাপতি, কমলগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সদস্যসচিব এবং স্থানীয় উইনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। একাডেমীর পরিচালক হলেন প্রধান সমন্বয়কারী। ৩বছর মেয়াদী কোর্সে নৃত্য, মৃদঙ্গ, পালাগান, সংগীত ও তবলা বিভাগে প্রশিক্ষণ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন রসমোহন সিংহ। ১৯৯৩ সালের সাফ গেমসে তারই নেতৃত্বে প্রায় দুইশত শিল্পী-সমন্বিত সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর (সরকারিকরণের আগ পর্যন্ত) পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তীকালে ২০০৩ সালে নতুন ভবন নিমাণপূর্বক সরকারিকরণের প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন করে সম্পূর্ণ সরকারি বিধিমোতাবেক জনবল নিয়োগ করা হয়। পরিচালক, গবেষণা কর্মকর্তা, গবেষণা সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর, পাঁচ বিভাগের পাঁচজন প্রশিক্ষক, এমএলএসএস, ড্রাইভার, পাহারাদার প্রভৃতি পদসৃষ্টিপূর্বক জনবল নিয়োগ দেয়া হয়। পরিচালকের দায়িত্বে নিয়োগপ্রাপ্ত হন রামকান্ত সিংহ। ২০০৫ সালের ৯ জুলাই নতুন ভবনের উদ্বোধন করেন তৎকালীন সরকারের অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান।
বর্তমানে মণিপুরী ললিতকলা একাডেমীতে নৃত্য, নাটক, সংগীত, বাদ্যযন্ত্র ও উপজাতীয় সংগীত (মণিপুরী সংগীত) এই পাঁচটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। সাপ্তাহিক ক্লাস ছাড়াও বাৎসরিক বিশেষ কর্মশালার আয়োজন করা হয়। মণিপুরী ললিতকলা একাডেমীর বর্তমান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে মণিপুরীদের ইতিহাস ঐতিহ্য লোকাচার ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নানান বিষয়ে পুস্তক-সাময়িকী প্রকাশনা, সেমিনার-কর্মশালা আয়োজন, বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসের উদযাপন, মণিপুরী সংস্কৃতি ও অপরারপর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী নানান উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় আয়োজিত নানান রাষ্ট্রিয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে মণিপুরী ললিতকলা একাডেমী। ২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশনা দেশ বিদেশের সুধিজনদের প্রসংশা অর্জন করে।
২০১০ সালে মণিপুণি ললিতকলা একাডেমি একটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজস্বখাতে অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ও শিল্প-সংস্কৃতির নানান শাখার দেশবিদেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ এই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন।